কাপুরুষ

—মোবায়দুল সাগর 

যারা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না তাদেরকে নাস্তিক বলে। তাহলে ভূতের অস্তিত্ব অস্বীকারকারীদের কি বলা যেতে পারে -- ভাস্তিক? কথায় আছে উত্তাল সমুদ্রে কেউ নাস্তিক হয় না। ঠিক তেমনি নিশীথে কবর-শ্মশানে কেউ ভাস্তিক হয় না। আমি একজন কট্টর নাস্তিক এবং ভাস্তিকও বটে। উত্তাল সমুদ্র বা নিশীথের কবর আমার সে আদর্শ থেকে একবিন্দুও নড়চড় করতে পারবে না এ বিশ্বাসটুকু আমার আছে। কিন্তু এই আদর্শে যেন ভাটা পড়েছিল গতবছর এপ্রিলে। গ্রীষ্মের ছুটিতে গিয়েছিলাম আমার দুঃসম্পর্কের এক মামারবাড়িতে। আমি গ্রামের নাম বলতে চাচ্ছি না কারণ হয়ত ভূত সন্ধানীরা সেখানে গিয়ে হাজির হবে। মামার বাড়ি যখন পৌঁছলাম তখন বিকাল হয়ে গেছে। খুব ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সাথে এখানে একবার এসেছিলাম। তারপরে আর কখনো আসা হয়নি।

 আমার এই মামা একজন অতিশয় বৃদ্ধ। তার বাড়িটাও তাঁরই মত জীর্ণ। দেওয়াল দুই পর্দার শেওলার চাদরে এবং অসংখ্য পরগাছায় ভরা। বাতাস চলাচলের ভেন্টিলেটর দখল হয়ে আছে চড়ই এবং কবুতরের বাসস্থানে। বাড়ির দক্ষিণ কোনে ছাদের এক অংশ ভাঙা। পিছনে বড় বড় কাঁঠাল গাছ এবং সম্মুখে আকাশচুম্বী নারকেল গাছ পাহারাদারের মত দাঁড়িয়ে আছে। বৃটিশ আমলের শেষের দিকে এই বাড়িটির নির্মান করেন আমার মায়ের দুঃসম্পর্কের এক চাচা। আশেপাশে দশ-বিশটা গ্রামে তাঁর খুব নামডাক ছিল। তাঁর পুত্র অর্থাৎ আমার এই মামারও খুব খ্যাতি আছে। কৃপণতার খ্যাতি -- হাড়কৃপণ যাকে বলে। বাপের স্মৃতির দোহাই দিয়ে তিনি এই ভগ্ন বাড়িতে দিব্যি সুখেই বাস করছেন। নতুন বাড়ি করার কথা তিনি তাঁর কল্পনাতেও স্থান দেন না। 

মামী আমাকে দেখে বললেন, "গরীবের বাড়ি তাহলে এসেছো। তোমরা বাপু শহরে থাকা মানুষ। পল্লী গ্রামের হাওয়ায় তোমাদের আবার এলার্জি হয় কিনা।" 

আমি হেসে বললাম, "পল্লী গ্রামের হাওয়ায় এলার্জি না হলেও তোমাদের বাড়ির যে অবস্থা তাতে করে আমার ফুসফুস এখনি বন্ধ হওয়ার উপক্রম। নতুন বাড়ি কি আর করবে না?"

 মামী মামার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন,"তিনি মহাশয় বাবার স্মৃতি রক্ষা করছেন। আল্লাহ যতদিন তাঁকে রক্ষা করছেন ততদিন পর্যন্ত এই বুড়ো বাড়িটার রক্ষা।" বলে মামী একটু আশেপাশে দেখলেন। স্বামীর মৃত্যুর কথা মুখে আনায় তিনি যেন লজ্জিত বোধ করলেন।

 সন্ধ্যার পরে আবহাওয়ার মাথা গেলো বিগড়ে। এমন বিধ্বংসী গরম ছড়িয়ে দিল যে ঘরে-বাইরে থাকা দুস্কর হয়ে পড়ল। আমি স্পটিফাই থেকে গান শুনছিলাম। মোবাইল নেটওয়ার্ক এখানে এক প্রকার কোহিনুর হীরার মত। গান থেমে থেমে চলছিল। আমার বিরক্তি শেষপর্যায়ে অবস্থান করছিল। কারণ আমি যখনি বই পড়তে যাবো তখনি বিদ্যুৎ গেল পালিয়ে। ঘরে কেরোসিন ল্যাম্প জ্বালানো হ'ল। আমি বই পড়া রেখে মোবাইলে একটি সিনেমা দেখতে লাগলাম। সাড়ে নয়টার দিকে মামী এসে খেতে ডাকলেন। আমি খেয়ে এসে ঘরে ঢুকলাম। তখন সাড়ে দশটা বাজে। সিনেমাটি শেষ করে চেতন ভগতের একটি বই পড়তে লাগলাম। কারণ ততক্ষণে বিদ্যুৎ লক্ষ্মী ছেলেটির মত ফিরে এসেছে। হতচ্ছাড়া আবার কখন যায় বলা যায় না। বই পড়তে পড়তে নিদ্রা আমার চোখে তপস্যারত মুনীর মত আসন গেড়ে বসতে চাইছিল। আমি আলো বন্ধ করে নিদ্রা বাবাজীর সেবাশুশ্রূষার ব্যবস্থা করলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি ঠিক জানি না। হঠাৎ দরজার কাছে আমি নুপুরের শব্দ শুনতে পেলাম। আমার চোখের পাতা তখন সুপার গ্লু দিয়ে আঁটা -- খুলতে চাচ্ছিল না। আমি পাশ ফিরলাম। হঠাৎ মনে হ'ল কে যেন খাটের শিয়রে বসল। সে উঠে দাঁড়াল এবং আমার মুখের কাছে নুপুর পায়ে এগিয়ে আসল। আমি হুড়মুড় করে উঠে বসলাম। মোবাইলে ফ্লাশ অন করে দেখলাম কেউ নেই। আমি কি তবে স্বপ্ন দেখলাম? নাঃ এ তো স্বপ্ন হতে পারে না। তবে কি আমি ভূল শুনলাম, ভূল অনুভব করলাম? 

দরজা খুললাম। লম্বা এক বারান্দা। আমার ঘরের দুইঘর উত্তরে মামা-মামীর ঘর এবং তিনঘর দক্ষিণে বাড়ির রাখাল মন্টু এবং তার স্ত্রী খোদেজা থাকেন। আমি চারিদিকে ফ্লাশের আলো দিয়ে দেখলাম। নারকেল গাছ থেকে ইঁদুর অথবা কাঠবিড়ালীর কিচিরমিচির শব্দ শুনতে পেলাম। ঘরে ফিরে এসে মনে মনে মুচকি হাসি দিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলাম "ভয় নামক কুসংস্কার তোমার মনে তাহলে স্থান নিয়েছে? কাঠবিড়ালীর কোন্দল-কলহ তোমার কাছে নুপুরের ঝুনঝুন শব্দ মনে হচ্ছে। কিন্তু কেন?" খুব সম্প্রতি আমি প্রেমেও পড়িনি যে সারাদিন মেয়ে নিয়ে অবাস্তব কল্পনা করে যাব‌ এবং রাতে সে স্বপ্নচারীনি নুপুর পায়ে আমার শয্যার শিয়রে বসবে। আমি কিছুক্ষণ ইনস্টাগ্রামে স্ক্রল করে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। আমি ঘুমাচ্ছি হঠাৎ অনুভব করলাম কেউ যেন আমার মুখের উপর তার গরম নিঃশ্বাস ফেলছে। আমি হাত দিয়ে তাকে ধরতে চাচ্ছিলাম কিন্তু সে আমার দুই হাত চেপে ধরে রেখেছে। আমার হাতের উপর যে বস্তু দুইটি শক্তি প্রয়োগ করছে তা দুইটি মানব হাতের মত।‌ তবে সে হাত মানবীর। যেন সে হাত দুটি হিম শীতল জলে চুবিয়ে আমার হাতের উপর চেপে রেখেছে। আমার পাদুটোর উপর যেন একটি বড় পাথর বসিয়ে রেখেছে। আমি শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে হাত-পা ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমি ব্যর্থ। আমি চেঁচানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু আমার মুখ থেকে ঠু শব্দ পর্যন্ত বের হ'ল না। আমার কন্ঠও তার অধিকারে। ক্ষণকালের জন্য এই পরিস্থিতিকে আমি স্বপ্ন বলে বিবেচনা করলাম। দাঁত দিয়ে জিহ্বায় কামড় দিলাম। হ্যাঁ, আমি ব্যাথা অনুভব করতে পারছি। মুহুর্তে আমি শূন্যে বিরাজমান হলাম। সে আমাকে টেনে ঘরের মাঝ উচ্চতায় ভাসমান করে দিল। যখন সে আমাকে টেনে তুললো তখন সেই নুপুরের ঝুনঝুন শব্দ আবার শুনতে পেলাম। বাম হাত থেকে সে তার হাত সরিয়ে আমার চোখ দুটি বন্ধ করে দিল -- আমি এক বৃহৎ সৌন্দর্য এবং ঐশ্বর্যমন্ডিত রাজপ্রাসাদ দেখতে পেলাম। রুপকথার গল্পে যেমন রাজপ্রাসাদ হয় ঠিক তেমনি। কিংবা সেন্ট ব্যাজলস ক্যাথিড্রাল গির্জার মত। রাজপ্রাসাদের সামনে লনে আমি দুইজন যুবক-যুবতীকে রাজ পোশাকে বেশ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আমার গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল যখন দেখলাম সেই যুবক আর কেউই নয় বরং আমি। সেই যুবতী মেয়েটিকে আমি দেখতে চাচ্ছিলাম না। আমি আমার বা হাত দিয়ে সেই ছায়া মূর্তির হাত আমার চোখ থেকে সরানোর চেষ্টা করলাম। সে আমাকে ছেড়ে দিল আমি সে উচ্চতা থেকে খাটে পড়ে গেলাম।

‌ আমি সারা শরীরে ব্যাথা অনুভব করলাম।‌ আমি হাত-পা সঞ্চালন করতে পারছিলাম না। ধর্মগ্রন্থে আছে মৃত্যুর পরে নাকি মুর্দার সারা শরীরে অসহনীয় ব্যাথা থাকে। তখন সে মনুষ্য স্পর্শ সহ্য করতে পারে না। সেই স্পর্শ তার কাছে তীব্র ব্যাথার মত অনুভূত হয়। আমিও ঠিক তেমনি ব্যাথা অনুভব করছিলাম। আমার চেতনা হারিয়ে যাওয়ার জন্য অব্যর্থ সুযোগ খুঁজছিল। মাথায় তীব্র যন্ত্রনা করছিল যেন আমি জিউস এবং এখনি মাথা ফেটে দেবী অ্যাথিনা বের হয়ে আসবে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। যখন চেতনা ফিরল তখন দেখি আমি আবার শূন্যে ভাসমান। আমার কানে যেন কেউ মৃদু ঠান্ডা নিঃশ্বাস ফেলছে। আমার মস্তিষ্কের নিউরনগুলো তখন আমার বিরুদ্ধে অবস্থান করছিল। আমার সামান্য চিন্তা শক্তিও তখন লোপ পেয়েছিল। আমি ভাল-মন্দ চিন্তা করতে পারছিলাম না। কাপুরুষের মত জ্ঞান হারালাম।


















ট্যাগ:

জীবনবোধের কবিতা ☆  দেশাত্মবোধক কবিতা ☆  ধর্মীয় চেতনার কবিতা ☆ প্রকৃতির কবিতা ☆ প্রতিবাদী কবিতা ☆ প্রেমের কবিতা ☆ বিবিধ কবিতা বিরহের কবিতা ☆ মানবতাবাদী কবিতা ☆ রূপক কবিতা ☆  রম্য কবিতা ☆  শিশুতোষ ছড়া-কবিতা ☆ চতুর্দশপদী কবিতা☆ সনেট কবিতা ☆ মহাকাব্য ☆ ছন্দবৃত্ত কবিতা ☆ মাত্রাবৃত্ত কবিতা ☆ অক্ষরবৃত্ত কবিতা ☆ পদ্য-গদ্য ☆ গল্প ☆ সাহিত্য☆ উপন্যাস ☆ বিখ্যাত কবিতা ☆ ছোট কবিতা ☆ নতুন কবিতা ☆ ভালো বাংলা কবিতা ☆ আনকমন কবিতা ☆ বিরহের কবিতা ☆ কবিতা বাংলা ☆ জীবনমুখী কবিতা ☆ উপন্যাস কি ☆ আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ☆ উপন্যাস কত প্রকার ☆ বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস ☆ জনপ্রিয় উপন্যাস ☆ বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ও বিকাশ ☆ ঐতিহাসিক উপন্যাস ☆ বাংলা উপন্যাসের ধারা ☆ শিক্ষনীয় গল্প ☆ হাসির গল্প ☆ বাংলা গল্প ☆ গল্প  রোমান্টিক ☆ জীবনের গল্প ☆ ভালো গল্প ☆ ছোট গল্প ☆ ডাইনি গল্প


3 মন্তব্যসমূহ

  1. নাস্তিক নাকি আস্তিক সেটা জানানোর প্রয়োজন দেখি না। সম্প্রদায় তৈরি করাটা অষৌক্তিক।
    গল্পটা ভালোই ছিল।

    উত্তরমুছুন
  2. নাস্তিক কি ভূতকে বিশ্বাস করল?

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. আপনি গল্পটা বুঝতে পারেননি মেবি।

      মুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন