ঋণ শোধ

—মোবায়দুল সাগর 


          প্রায় সাত ঘন্টা বাসের সিটে বসে থাকা আমার কাছে অস্বস্তিকর। আমি একজন ভ্রমণপিপাসু মানুষ! তারপরেও যশোর থেকে বগুড়া ভ্রমণ আমার কাছে অসহ্য লাগে। যতটা না অসহ্য লাগে বর্তমানের বাংলা গানগুলো। এই সাত ঘণ্টায় বাসে গান শুনে কাটিয়ে দেই। তবে এক সময় ভালো লাগে যখন - বাস, 'লালন শাহ' সেতুর উপর দিয়ে যায়। পদ্মার এপাড়ে অর্থাৎ কুষ্টিয়ায় দেখা মেলে, 'ভেড়ামারা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র' এবং ওপাড়ে দেখা যায় দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। আর দেখা যায় লালন শাহ সেতু থেকে মাত্র ২১ মিটার দূরের শতবর্ষী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। 

         বাস নাটোরে পৌঁছালেও দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়। কারণ সেখান থেকে বগুড়ার দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। অসহ্য! অসহ্য! তারপরেও জানালার বাইরে চোখ রেখে উপভোগ করি চলন বিলের সৌন্দর্য। গত জানুয়ারিতে যশোর থেকে বগুড়ায় যাচ্ছিলাম। এই ভ্রমণও বরাবরের মতই অস্বস্তিকর যাচ্ছিল। উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। বাস যখন পদ্মা পার হয়ে যায় তখন বাসে লোকাল যাত্রী ওঠানো হয়। বাসে তখন তিল ধারনের জায়গা থাকে না। আমি ওদিকে লক্ষ্য করি না। নড়াইল থেকে ঝিনাইদহে বা বেনাপোলে যাওয়ার সময় বাসে যখন খুব ভিড় তখনও আমি সেদিকে লক্ষ্য করি না। তবে হেলপারের সেই ঐতিহাসিক সংলাপগুলো, "বাসে সিট খালি আছে" বা "বাস পুরো ফাঁকা" ইত্যাদি খুব উপভোগ করি। 

         নন্দীগ্রাম থেকে পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের  এক লোক বাসে ওঠে আমার সিটের পাশে দাঁড়ালেন। লোকটি উচ্চাতায় খর্বাকৃতি। আমার সিট ছিল বাসের ডান পাশে। আমি লোকটাকে তেমন খেয়াল করিনি‌। আমি ব্যস্ত গান শোনাই। নন্দীগ্রাম ছেড়ে বাস খুব দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে। হঠাৎ বাসে এক ব্রেক কষলে, আমার পাশে দাঁড়ানো খর্বাকৃতির লোকটি পড়ে গেলেন। তিনি কোনোমতে নিজেকে সামলালেন। তিনি আসলে বাসের মধ্যে ঝুলে থাকা হাতল নাগাল পাচ্ছিলেন না। আমি সেই দৃশ্য দেখে সঙ্গে সঙ্গে নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে তাকে বসতে দিলাম। তিনি বসতে চাচ্ছিলেন না। আমি তাকে জোর করলাম। শেষমেষ তাকে বসতে হ'ল। তিনি অত্যন্ত খুশি হলেন। তার চোখে-মুখে খুশির ছাপ বোঝা যাচ্ছিল। যেমনটা বোঝা যায় একটি ছোট্ট শিশুর হাতে ক্যান্ডি দিলে। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "আমি কোথায় যাবো?" বাসের গন্তব্য ছিল পঞ্চগড়। 

         আমি বললাম, "বগুড়ায়!"

         তিনি বললেন, "আমিও বগুড়ায় যাচ্ছি।"

        তিনি আমার পরিচয় নিতে থাকলেন। কি নাম, বাড়ি কোথায়, কোন ক্লাসে পড়ি, কোথায় পড়ি ইত্যাদি। 

      আমি তার সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। তবে আমি তার সম্পর্কে একটি প্রশ্নও করলাম। কারণ আমার মন খারাপ ছিল। যেহেতু বগুড়া পৌঁছাতে এখনও দেরি আছে। তিনি আমাকে বললেন, "বাবা, খাটো মানুষ তো। এজন্য নাগাল পাচ্ছিলাম। তবে তুমি আমাকে বসতে দিয়েছো‌, খুব খুশি হয়েছে। 

      আমি বললাম, "এটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষকে নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে তাকে বসতে দেওয়া।" 

      তিনি হাসিমুখে বললেন,"আমার বয়স তেমন হয়নি। উচ্চতার জন্য দাঁড়াতে পারছিলাম না।" 

     লোকটি বগুড়ার ভাষায় কথা বলছিলেন না। আমি ভাবলাম লোকটা খুলনা অঞ্চলের। শাকপালা পৌঁছানোর আগে তিনি বললেন, "কোথায় নামবে?"

       "শাকপালায়। তবে আমাকে সাতমাথায় যেতে হবে।"

       "আমিও সাতমাথায় যাবো। কিন্তু চারমাথা থেকে যাবো।" 

       বাস শাকপালা পৌঁছালে আমি নেমে গেলাম। নেমে একটি সিএনজিতে উঠলাম। কিছুক্ষণ সিএনজিতে বসে থাকতে হ'ল। সিএনজিতে যাত্রী পূর্ণ হলেই তবে ছাড়বে। সেই লোকটি সিএনজিতে উঠলেন। আমাকে বললেন, "বাস শাকপালায় যাত্রাবিরতি করছে, ছাড়তে সময় লাগবে।" 

      বগুড়া শহরে প্রবেশ করছি। শরীরে শিহরণ জেগে উঠছে। সাড়ে পাঁচ লক্ষ বাসিন্দার বগুড়ার শহর। আমার কাছে অন্যরকম এক অনুভূতি জোগায়। যে শহর কখনো ঘুমায় না। যে শহরে থাকে কর্ম ব্যস্ততা। সকল পেশার মানুষের দেখা মেলে সেখানে। সিএনজি পৌর এডওয়ার্ড পার্ক গেইটের সামনে থামল। আমি নেমে ভাড়া দিতে যাব তার আগেই সেই অপরিচিত লোক আমার ভাড়া দিয়ে দিলেন। আমি তৎক্ষণাৎ অবাক হয়ে গেলাম। সিএনজিতে আরো লোক বসে ছিল। তারা আমার ভাড়া দেয়নি। সেই অপরিচিত লোকটি দিয়েছেন যাকে আমি বাসে নিজের সিট ছেড়ে তাকে বসতে দিয়েছিলাম। আমার মধ্যে অসম্ভব অবাক হওয়ার ভাবটা এখনও রয়েছে। 

      আমি তাকে বললাম, "আপনি আমার ভাড়া দিয়েছেন কেন?" 
      
        তিনি বললেন, "ঠিক আছে, সমস্যা নেই।" 
      
        আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, "আপনি কি করেন?"

        তিনি বললেন, "নন্দীগ্রামের, একটি হাইস্কুলের শিক্ষক। শহরে কাজ ছিল তাই এসেছি।" 

     ‌ ‌ একজন অপরিচিত আমার সিএনজি ভাড়া দিবে তা আমি মানতে পারছিলাম না। আমি আবার তাকে  বললাম, "ভাড়া দেওয়ার কোনো প্রয়োজন ছিল না।" 

        তিনি হেসে বললেন, " সমস্যা নেই। যায়, দোয়া করবে!" 

        "ভালো থাকবেন!" 

        "দোয়া করবে, ভালো থাকো!" 

     তিনি তার পথে চললেন। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি বাসের মধ্যে আমার নৈতিক দায়িত্ব পালন করেছিলাম মাত্র। তিনিও সেই উপকারের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আমার সিএনজি ভাড়া দিলেন। আমি হয়ত তাকে শিখিয়েছি - "মানুষকে উপকার করো!" তিনি হয়ত আমাকে শেখালেন - "সেই উপকারের প্রতিদান!" তিনি আমার উপকারের ঋণ হয়ত ঘুচাতে পারতেন না, যদি না আমরা এক সিএনজিতে আসতাম। তিনি হয়ত অনুশোচনাবোধ করতেন। তবে তিনি আমাকে সেই ঋণ শোধ করে দিলেন। আমি অবাক হয়েছি! আমি বগুড়া শহরে প্রবেশ করেই নতুন কিছু শিখেছি। আমি তাকে চিনি না, তিনিও আমাকে চেনেন না। কিন্তু মনে হ'ল আমাদের জন্য একটা সম্পর্ক রয়েছে। মানুষ - মানুষে সম্পর্ক। যা রক্তের সম্পর্ক নয়। যেটা স্বার্থহীন - মানুষ মানুষের জন্য। আমি আমার নৈতিক দায়িত্বকে মোটেই উপকার বলব না।  আমার কাছে উপকার বলে কোনো শব্দ নেই। আমার কাছে সব দায়িত্ব। আমার নিজের, পরিবারের, সমাজের, দেশের  এবং পৃথিবীর প্রতি। যেখানে থাকি যতটুকু সম্ভব আমি আমার দায়িত্ব পালন করব। 

          "হয়ত কোনো আগন্তুক আবার আসবে -
আমার উপকারের দায়িত্বে অথবা আমার কর্তব্যে,
আমি স্বার্থরক্ষা দলের লোক না, আমি সেই তবে,
আমি ক্ষুদ্র অ্যামিবার ন্যায় - আমি থাকব সরবে।" 
















ট্যাগ:

জীবনবোধের কবিতা ☆  দেশাত্মবোধক কবিতা ☆  ধর্মীয় চেতনার কবিতা ☆ প্রকৃতির কবিতা ☆ প্রতিবাদী কবিতা ☆ প্রেমের কবিতা ☆ বিবিধ কবিতা বিরহের কবিতা ☆ মানবতাবাদী কবিতা ☆ রূপক কবিতা ☆  রম্য কবিতা ☆  শিশুতোষ ছড়া-কবিতা ☆ চতুর্দশপদী কবিতা☆ সনেট কবিতা ☆ মহাকাব্য ☆ ছন্দবৃত্ত কবিতা ☆ মাত্রাবৃত্ত কবিতা ☆ অক্ষরবৃত্ত কবিতা ☆ পদ্য-গদ্য ☆ গল্প ☆ সাহিত্য☆ উপন্যাস ☆ বিখ্যাত কবিতা ☆ ছোট কবিতা ☆ নতুন কবিতা ☆ ভালো বাংলা কবিতা ☆ আনকমন কবিতা ☆ বিরহের কবিতা ☆ কবিতা বাংলা ☆ জীবনমুখী কবিতা ☆ উপন্যাস কি ☆ আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ☆ উপন্যাস কত প্রকার ☆ বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস ☆ জনপ্রিয় উপন্যাস ☆ বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ও বিকাশ ☆ ঐতিহাসিক উপন্যাস ☆ বাংলা উপন্যাসের ধারা ☆ শিক্ষনীয় গল্প ☆ হাসির গল্প ☆ বাংলা গল্প ☆ গল্প  রোমান্টিক ☆ জীবনের গল্প ☆ ভালো গল্প ☆ ছোট গল্প ☆ ডাইনি গল্প


 

 
    

   


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন