ক্ষণিকের খেলনা
—মোবায়দুল সাগর
সুমি আপু, আমাকে মেসঞ্জারে একটি পাঠ্য দিল, 'ঐ!' আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। আমার সামনেই সে বসে আছে। এবং তার পাশে ওর মা অর্থাৎ আমার মামী। তবে,'ঐ!' লেখাতে আমি অন্য কিছু উপলব্ধি করতে পারছিলাম। এই "ঐ!" লেখাটা সাধারণ , 'ঐ!' লেখার মতো মনে হ'ল না। বিশেষ কিছু যেন মিশে আছে। যেমন মিশে থাকে কোনো রহস্যময়ী নারীর হাসির মধ্যে।
আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ জন্ম নিল। আমি, 'ঐ!' এর প্রত্যুত্তরে লিখলাম, 'জ্বী!' সে লিখল - 'কি করছিস?'
আমি উত্তরে লিখলাম, 'বসে আছি!' সাথে একটি ভাবুক ইমোজি।
সে লিখল, 'বারবার ফোনের দিকে তাকাস না; মা সন্দেহ করবে।'
আমি সুমি আপুর কথা বুঝতে পারলাম না। কথাটা যেন ফিজিক্সের থিওরির মত মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। সুমি আপু কেন এমনটা বলল? আমার মস্তিষ্ক সেই উত্তর খুঁজতে আদা জল খেয়ে নেমেছে। সুমি আপু, সে তো বয়সে আমার থেকে দুই বছরের বড়। আমার ছোট মামার দুই মেয়ে। রুমি আপু এবং সুমি আপু। রুমি আপু বড়, অত্যন্ত সুন্দরী! সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়ছেন। সুমি আপু ছোট; তবে সে রুমি আপুর মত অতটা সুন্দর নয়। গাত্রবর্ণ শ্যামলা। সে ঝিনাইদহ পলিটেকনিকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এর ষষ্ঠ পর্বের ছাত্রী। ছোট মামা গণপূর্ত বিভাগের একজন সহকারী প্রকৌশলী। বর্তমানে তিনি ঝিনাইদহে থাকেন। শহরের কাঞ্চননগরে পাঁচ তলা বিশিষ্ট এক বাড়ি বানিয়েছেন। প্রায় তিনি আমাকে সেখানে যেতে বলেন।
মামা এতো করে বলেন কিন্তু সময়ের অভাবে কখনো সেখানে যাওয়া হয়না। অবশেষে গতকাল সকালে যশোর থেকে ঝিনাইদহের দিকে রওনা দিলাম। মামা ঠিকানা বলে দিয়েছিলেন। আমি সেই ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি রুমি আপু বাসায়। তিনি আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি আমাকে বললেন, 'তুই তো অনেক বড় হয়ে গেছিস। সেই কবে তোকে দেখেছি। যাক তোর সাথে দেখা হয়ে গেল। আমি আগামীকাল রাজশাহী চলে যাচ্ছি।' মামা বাসায় ছিলেন না। মামীও আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন। তিনিও একই কথা বললেন আমি অনেক বড় হয়ে গেছি ইত্যাদি।
সন্ধ্যার দিকে রুমি আপু এবং সুমি আপু আমার সাথে গল্প করতে লাগল। তারা যে আমার সাথে গল্প করবে এটা ভাবতে পারছিলাম না। তাদের সাথে আমার সম্পর্কটা আসলে যায় না। তাদের পরিবার এবং আমার পরিবারের আকাশ-পাতাল পার্থক্য। যতই ওরা আমার মামাতো বোন হোক না কেন। এর আগে যখন তাদের সাথে দেখা হয়েছে আমি সৌজন্যমূলক কথাবার্তা বলেছি এবং তারাও একই আচরণ করেছেন। আমি একটু রসিক ছেলে। খুব সহজেই মানুষকে হাসাতে পারি। বাচনভঙ্গিও খুব সরল। মেয়েরা রসিক মানুষ খুব পছন্দ করে। আমার সাথে কথা বলে ওরা খুব মজা পাচ্ছিল। আমিও ওদের আগ্রহ দেখে, আমার রসের জগতের দ্বার খুলে দিলাম। অনেকক্ষন ধরেই আলাপ করলাম। বিভিন্ন বিষয়ে। তবে আমি সব বিষয়ে মশকরা করছিলাম। আর ওরা সেটা খুব সহজেই ধরতে পারছিল। ওরা খুব হাসছিল; মেয়েদের হাসি আমার কাছে কুৎসিত লাগে। তারপরেও ওদের মধ্যে যেন খুঁজে পেলাম বাচ্চা মেয়েদের মত চঞ্চলতা।
সকাল বেলা রুমি আপু রাজশাহী চলে গেলেন। সারাদিন ঘরে বসেই কাটালাম। বসার ঘরেই বসে ছিলাম সারাদিন। দুপুরে খেয়ে দিবানিদ্রায় চলে গেলাম। যদিও এটা আমার নিত্যদিনের অভ্যাস। কিন্তু এখানে এসে ঘুমাতে লজ্জাবোধ করছিলাম। একজন তরুণ দুপুরে কিভাবে ঘুমাতে পারে এই ভেবে। মামা-মামী অথবা সুমি আপু আমাকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অলসের খেতাব দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু আমি করতামটা কি? আমি ঝিনাইদহের কিছুই চিনি না; আর একা ঘোরার কোনো মানে হয় না। যারা ভবঘুরে, সাধু-সন্ন্যাসী তাদের দ্বারা একা একা পৃথিবী ঘোরা সম্ভব কিন্তু আমার মতো মিশুক ছেলের পক্ষে তা নিতান্তই অসম্ভব। বিকালে ঘুম থেকে উঠে ছাদে গেলাম। সন্ধ্যার দিকে ছাদ থেকে নিচে নেমে আসলাম।
মামী আমার জন্য চা নিয়ে আসলেন। সুমি আপুর কথা আমিই ভূলেই গেছিলাম। সারাদিন আমি ওকে দেখিনি। কিন্তু এখন সে আমার সামনে বসে আছে। আমি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। আমি কি করে ওর কথা ভূলে গিয়েছিলাম। সুমি আপুর পাশেই মামী বসে টিভি দেখছেন।
রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে গেলাম। সুমি আপু আমাকে মেসঞ্জারে লিখল, 'কবে চলে যাবি?'
'কাল সকালে।'
'কাল থেকে যা!'
'কেন?'
'তোকে ঝিনাইদহ ঘুরিয়ে দেখাব। অনেক কিছু আছে এখানে। তুই কাল এখানে থেকে, পরশুদিন চলে যাস।'
'আচ্ছা ঠিক আছে!'
'কি করছিস?'
এই প্রশ্নের মানে আমি বুঝি না। কেউ মেসেঞ্জারে চ্যাট করার সময় নিশ্চয় ক্রিকেট খেলে না। সে হাতে মোবাইল নিয়ে শুয়ে অথবা বসে চ্যাট করে। এটাই তো? যা পৃথিবীর সবাই জানে। তারপরেও জিজ্ঞাসা করবে 'কি করছি?' আজব দুনিয়া!
'গোল্লারছুট খেলছি! খেলবেন?'
'হাঃহাঃহাঃ, তুই খুব মজার কথা জানিস!'
আমি দুইটা ইমোজি পাঠালাম।
সুমি আপু আমাকে হঠাৎ লিখল, 'কখনো প্রেম করেছিস?'
আমি শুনে খুব অবাক হয়েছি; যতটা না অবাক হয়েছিলাম ক্যাঙ্গারু শব্দের অর্থ 'আমি জানি না' জেনে।
আমি লিখলাম, 'গরু-ছাগল পোষার ব্যাপারে আমার কোনো আগ্রহ নেই!'
'তুই সব ব্যাপারে এত ঠাট্টা করিস কেন?
'আমি এমনই; একটু অদ্ভুত!'
ও এবার আমাকে হকচকিয়ে দিল। আমি এইটা কখনো আশা করিনি। ও লিখল, 'আমাকে তোর কেমন লাগে?'
এই প্রশ্নের মানে কি তা কৈশোরে উপনীত একটা ছেলে বা মেয়ে খুব সহজেই বুঝে যাবে। ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন হবে না। সেখানে আমি তরুণে পদোন্নতি পেয়েছি। ব্যাপারটা আমার বুঝতে বাকি রইল না। আমি সাবলীল ভাবে লিখলাম -
'বোন হিসেবে আপনি যথেষ্ট ভালো। আশা করছি, আপনার এই ভাইয়ের জন্য জগতের শ্রেষ্ঠ মেয়েটি এনে দিবেন।'
সুমি আপু কোনো রকম সংকোচ না করে লিখল, 'আমার সাথে প্রেম করবি!'
এবার আমি একবিন্দুও অবাক হয়নি। তবে বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলাম। আমাকে কাল সকালে নয় - এখনি এখান থেকে বেরোতে হবে।
ও এবার আমার ফোন নম্বর চাইল। আমি ফোন নম্বর দেওয়ার সাথে সাথেই আমাকে ফোন করল।
"কি বল?"
"আমি এ প্রশ্নের জবাব দিতে চাচ্ছি না"
"আমাকে তোর ভালো লাগে না?
"আচ্ছা তার আগে বলেন আপনার এতো পরিবর্তন কি করে?"
সুমি আপু ফোনটা কেটে দিয়ে লিখল, ''আগামীকাল তো থাকছিস; তোকে সব বলব।''
আমি ভূল করে লিখে ফেললাম, 'আগামীকাল থাকতে পারছি না। যশোরে জরুরী কাজ রয়েছে।'
আমি আসলে চাচ্ছিলাম খুব ভোরে উঠে চলে যাব। সুমি আপু ঘুম থেকে ওঠার আগেই।
সে লিখল, 'আমি বলছি তুই কালকে থাকবি তো থাকবি। এর বেশি একটা কথাও বলবি না। নাহলে আজীবন তোর সাথে কথা বলব না।"
সে আবার লিখল, 'প্লিজ তুই আমার এই অনুরোধটা রাখ!'
আমার পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমার এক পাশে অগ্নুৎপাত আর এক পাশে গিরিখাত। গিরিখাত থেকে নামা হয়ত সহজ কিন্তু অগ্নুৎপাত? আচ্ছা এই অগ্নুৎপাতটা কে? আমি সুমি আপুকে লিখলাম, 'আচ্ছা ঠিক আছে!'
ঘড়িতে সময় দেখলাম প্রায় দুইটা। ঘুম আসবে কি-না কে জানে? সারারাত চিন্তা করেই কেটে যাবে। ঝিনাইদহে এসে এমন মহামুশকিলকে পড়তে হবে আগে জানলে আসতাম না। কখন ঘুমিয়ে গেলাম মনে পড়ল না। খুব সকালে ওঠা আমার অভ্যাস। কিন্তু আজ ঘুম ভাঙল সুমি আপুর চেঁচানোতে। সে বলল, 'এতোবড় একটা ছেলে ফজরের আজানের পর কিভাবে ঘুমায়? এই ওঠ বলছি। নামাজ পড়তে যা।' আমি বাধ্য হয়ে নামাজ পড়তে গেলাম।
ফিরে এসে দেখি সুমি আপু আমার জন্য চা নিয়ে বসে আছে। এক কাপ চা দিয়ে বলল, 'কেমন হয়েছে? আমি নিজের হাতে বানিয়েছি।' ওর হাতের চা খাওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার ছিল না। কিন্তু আমি বাঁধা পড়েছি। আমাকে চা খেতে হ'ল। আশ্চর্য! ও যে এতো সুন্দর চা বানাতে জানে আমি জানতাম না। আমি প্রশংসা করব কি-না বুঝতে পারছি। প্রশংসা করা মানে সিংহের ডেরায় পা দেওয়া। ও উৎসাহী হয়ে জানতে চাইল, 'কেমন হয়েছে?' আমি মৃদু স্বরে বললাম, 'চা কখনো কেমন হয় না। এর স্বাদ যেযন তেমনি হয়েছে। হালকা লবণাক্ত হালকা হলুদাক্ত। ও উচ্চস্বরে হেসে উঠে বলল, 'তোকে যদি কোনো স্টান্ড আপ কমেডির প্রতিযোগিতায় দেওয়া হয় তাহলে নিশ্চিত তুই প্রথম পুরস্কার নিয়ে আসবি।'
আমি নিরস হয়ে বললাম, 'খুব সম্ভবত!'
এ আমি কাকে দেখছি। আমার জায়গায় যে কেউ থাকলে জোরে চেঁচিয়ে উঠতো। যেন দিনের বেলা ভূত দেখেছে। যে মেয়ে টাইট জিন্স পরতো সে ঢিলাঢালা বোরকা পরেছে। শুধু চোখ দুইটা দেখা যাচ্ছে; এমনকি হাতে পায়ে মোজা পরেছে। আমাকে বলল, 'তুই এখনো রেডি হোসনি? শিগগিরই ওঠ।'
একটা রিকশায় করে আমরা এক পার্কের দিকে যাচ্ছি। আমরা পাশাপাশি বসেছি। রিকশায় হুড নামিয়ে রাখা। আমরা পথে একটি কথাও বললাম না। মিনিট পনেরো পর পৌঁছে গেলাম শহরতলীর ব্যক্তিগত সেই বিনোদন কেন্দ্রে। আমরা, একটি কংক্রিটের বেঞ্চে বসে আছি। সুমি আপু আবার সেই প্রশ্ন হাসি মুখে জিজ্ঞাসা করল, 'তাহলে প্রেম করিসনি?'
'না, প্রয়োজনবোধ করিনি। মোদ্দা কথা তেমন কোনো মেয়ে না চোখে পড়েনি।'
'কেমন মেয়ে তোর পছন্দ?'
'ঐশ্বরিয়া রায়, এঞ্জেলিনা জোলির মতো সুন্দরী হতে হবে না। মনের সৌন্দর্য আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।'
সুমি আপু অন্যদিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল, 'আমি তিনটা প্রেম করেছি। ক্লাস এইটে প্রথম প্রেম। সেই প্রেম দুই বছর ছিল। তারপর আরেকটি ছেলের সাথে এক বছরের প্রেম। আর তৃতীয়টা ভেঙে গেছে কিছুদিন আগে। এই ছেলেটাকে আমি খুব ভালোবাসতাম। আমাদের বিয়ের পরিকল্পনাও ছিল। কিন্তু কিভাবে যে কি হয়ে গেল। ঐ ছেলের সাথে বিচ্ছেদের পর আমি নিজেকে পরিবর্তন করে ফেলেছি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, কঠোর পর্দা করি। সর্বোপরি সবদিকে পরিবর্তন করে ফেলেছি।
সুমি আপু মাথা নিচু করে বসে রইল। কাঁদছে কি না কে জানে। মেয়েরা খুব সহজেই কাঁদতে পারে। আমি ও দিকে খেয়াল না করে, ফোনে আইল ঠেলাঠেলি করতে লাগলাম। হঠাৎ খুব উৎসাহের সাথে সুমি আপু বলল, 'আইসক্রিম খাবি!'
আমি ভ্রু দুইটা কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। যেন অদ্ভুত কোনো প্রস্তাব ও আমাকে দিয়েছে। আমি বললাম, 'খাওয়া যায়।' ও দুইটা আইসক্রিম কিনে নিয়ে আসল। আমার হাতে একটা ধরিয়ে দিয়ে নিজে একটি খুব খুশি খুশি আইসক্রিম খেতে লাগল। মুখটা এখন অনাবৃত। আমি ওর আইসক্রিম খাওয়া দেখছিলাম। আমি ওর আইসক্রিম খাওয়ার মধ্যে একটি শৈল্পিক ভাব খুঁজে পাচ্ছিলাম। আইসক্রিম খাওয়ার মধ্যে শৈল্পিক ভাব। বড্ড হাস্যকর! কিন্তু আমার কাছে এমন মনে হচ্ছে কেন? প্রকৃতি এ কোন খেলায় মেতেছে। আমি যেন ঘোরের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছি। আমি নিজের আইসক্রিমের দিকে মনোযোগ দিলাম।
সুমি আপু কঠিন স্বরে আমাকে বলল, 'আমার চোখে তাকা!'
'আপনার ঠোঁটের কোণে আইসক্রিম লেগে আছে!'
'উহুঁ, বড় জ্বালাতন করিস তুই।'
ও ঠোঁটের কোণ থেকে আইসক্রিম মুছে আবার কঠিন স্বরে পুনরায় বলল ,'আমার চোখে তাকা!'
ট্যাগ:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন